
কুড়িগ্রামের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (আরডিসি) নাজিম উদ্দিন (প্রত্যাহার হয়ে বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত) সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে মধ্যরাতে ধরে নিয়ে নির্যাতনের ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় এসেছেন। তবে তার অপকর্ম এটাই প্রথম নয়, এর আগেও মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে অনেককেই সাজা দিয়েছেন তিনি, যাদের বেশিরভাগই নিরীহ। এভাবে সাজা দেওয়া ও মানুষকে ভয়ভীতি দেখানো ছিল তার একটি নেশা। ২০১৮ সালে কক্সবাজারে ষাটোর্ধ্ব মোহাম্মদ আলী ওরফে নফু মাঝিকে কান ধরে টেনেহিঁচড়ে মারধর করেছিলেন তিনি। সেই নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। ২০১৯ সালে মাগুরার এসিল্যান্ড থাকা অবস্থায় সাধারণ মানুষকে মারধর, বাড়িঘর ভাঙচুরসহ তার বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগে বিভাগীয় মামলাও হয়েছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আলোচনায় এসেছে দরিদ্র পরিবারের সন্তান নাজিমের হঠাৎ বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার বিষয়। যশোরের মনিরামপুরের কাশিপুর গ্রামে নানার দেওয়া জমিতে বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে তার। একই উপজেলার হোগলাডাঙ্গা গ্রামে শ্বশুরবাড়ির পাশে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে চারতলা আরেকটি বাড়ি নির্মাণ করছেন নাজিম। ঢাকাতেও নামে-বেনামে প্লট ও ফ্ল্যাট রয়েছে তার। সরকারি চাকরি পাওয়ার ছয় বছরের মাথায় হঠাৎ বিত্তবান হওয়ায় বিস্মিত এলাকাবাসীও।
যশোরের মনিরামপুর উপজেলার দূর্বাডাঙ্গা গ্রামের মৃত নিছার উদ্দিনের ছেলে নাজিম উদ্দিন খেদাপাড়া ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামে নানাবাড়িতে বড় হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে ২০১৪ সালে ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথমবারেই উত্তীর্ণ হয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হন। তার চাকরির ব্যাপারে স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধির সুপারিশ ছিল বলেও জানা গেছে।
গতকাল সোমবার স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার পর থেকে নাজিম এলাকার মানুষকে কারণে-অকারণে ভয় দেখাতেন। কুড়িগ্রামে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় নাজিমের জড়িত থাকার বিষয়টি জানাজানি হলে অনেকে তার ব্যাপারে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তার হঠাৎ অর্থবিত্তের মালিক হওয়া নিয়েও চলছে আলোচনা।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তার এক ভায়রার সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির পাশেই সাড়ে ১৪ লাখ টাকায় কেনা আট শতক জমিতে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে চারতলা একটি বাড়ি নির্মাণ করছেন নাজিম উদ্দিন। এ ছাড়া কাশিপুরে নানার দেওয়া পাঁচ শতক জমির ওপর তিনকক্ষের একতলা মনোরম বাড়ি রয়েছে তার। অবশ্য নাজিম উদ্দিনের স্ত্রী সাবিনা সুলতানা বলেছেন, ‘আব্বার দেওয়া জমিতে আমরা দুই বোন মিলে বাড়ি করছি। বাড়ির খরচ আমার বোনই দিচ্ছেন।’
বিশ্বনাথ পরিবারে মধ্যরাতের বিভীষিকা :গতকাল দুপুরে কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবে এসে নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের বিশ্বনাথ দাসের পরিবার ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দেয়। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে বাড়ির সবাইকে মারধর করে বিশ্বনাথকে তুলে নিয়ে সেই রাতেই ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মজনু নামের আরেকজনকে দেওয়া হয় ছয় মাসের কারাদণ্ড। পরদিন মজনুকে জামিন দিলেও বিশ্বনাথ ছাড়া পাননি। ২০ দিন ধরে কারাগারে আছেন পেশায় জেলে বিশ্বনাথ দাস। তাদের দেওয়া দণ্ডের কোনো নথিপত্রও দেননি নাজিম উদ্দিন।
বিশ্বনাথের কাকা স্বপন চন্দ্র বর্মন, স্ত্রী পার্বতী রানী দাস, বোন শুক্লা দাস ও ভাই বাবলু নম দাস জানান বিশ্বনাথ, পঞ্চয়েতপাড়ার আঙ্গুর ও মোখলেছ মিলে উন্মুক্ত জলাশয় গিরাই নদীর দেবীকুড়ায় বাঁধ দিয়ে মাছের পোনা ছেড়েছিল। এটাই ছিল তাদের অপরাধ। এখানে মাছের পোনা ছাড়ার আইনগত বাধা না থাকলেও ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১২টার দিকে নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে পুলিশসহ কিছু কর্মকর্তা বাড়িতে ঢুকে মারধর করে বিশ্বনাথকে ধরে নিয়ে যায়। এ সময় বিশ্বনাথের স্ত্রী, মা, কাকা ও ভাইকে মারধর করা হয়। এরপর তারা যায় আঙ্গুর ও মোখলেছের বাড়ি। সেখানে গিয়েও বাড়ির লোকজনকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। আঙ্গুর ও মোখলেছকে বাড়িতে না পেয়ে ধরে নিয়ে যায় আঙ্গুরের বাবা মজনুকে। রাতেই ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে বিশ্বনাথকে এক বছর ও মজনুকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি মনে করতে চান না নফু মাঝি :কক্সবাজার সদর উপজেলায় এসিল্যান্ড থাকাকালে ২০১৮ সালের মে মাসে শহরের কলাতলী এলাকার মোহাম্মদ আলী ওরফে নফু মাঝি (৬২) নামে এক বৃদ্ধকে কান ধরে টেনেহিঁচড়ে মারধর করেন নাজিম উদ্দিন। নির্যাতনের ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। গতকাল সকালে নফু মাঝি সমকালকে বলেন, ‘নির্মম ওই ঘটনার কথা আর মনে করতে চাই না।’
কক্সবাজারের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপলসের প্রধান নির্বাহী ও সাংবাদিক রাশেদুল মজিদ বলেন, তৎকালীন এসিল্যান্ড নাজিম উদ্দিনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছিলাম। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়। আমি হাজির হলেও নাজিম সেখানে উপস্থিত হননি। পরে তাকে শাস্তিমূলকভাবে রাঙামাটির লংগদুতে বদলি করা হয়।
তিনি আরও বলেন, কক্সবাজারের সাবেক ওই এসিল্যান্ড দায়িত্ব পালন করার সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে নানা অপকর্ম করে গেছেন। খাসজমি বন্দোবস্ত দেওয়ার আশ্বাসে ঘুষ-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সাধারণ মানুষকে নানাভাবে নাজেহাল করতেন তিনি।
মাগুরায় নাজিমের যত অপকর্ম :অক্টোবর ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় এসিল্যান্ড হিসেবে কর্মরত ছিলেন নাজিম উদ্দিন। সে সময় তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে অসদাচরণ, মারধর, বাড়িঘর ভাঙচুরসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন। ব্যক্তিমালিকানার জমি খাস দেখিয়ে সরকারি বরাদ্দের নামে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। উপজেলার জোকা গ্রামের সৈয়দ ছদরুদ্দীন একটি কেনা জমি রেজিস্ট্রি করতে দেড় লাখ টাকা ঘুষ দেন নাজিম উদ্দিনকে। ঘুষ নিয়েও এসিল্যান্ড নাজিম সাব-রেজিস্ট্রারকে জমি রেজিস্ট্রি করতে নিষেধ করেন। এর প্রতিবাদ করলে ছদরুদ্দিন ‘জাল মুক্তিযোদ্ধা সনদের ব্যবসা করেন’- এমন মিথ্যা অভিযোগে মধ্যরাতে তার বাড়িতে হানা দেন। ছদরুলকে বাড়িতে না পেয়ে বাড়ির আসবাবপত্র ভাঙচুর ও তার স্ত্রীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন নাজিম। মহম্মদপুর সদরে ওষুধ ব্যবসায়ী বাদশা ফকিরের পৈতৃক জমি সরকারের নামে রেকর্ড হয়। সেই জমির রেকর্ড সংশোধনের জন্য বাদশা তিন লাখ টাকা ঘুষ দেন নাজিমকে। পরে রেকর্ড সংশোধন তো দূরের কথা লাখ লাখ টাকা নিয়ে সেই জমি বিভিন্নজনের কাছে বরাদ্দ দেওয়া শুরু করেন তিনি। এ ঘটনার প্রতিবাদ ও ঘুষের টাকা ফেরত চাইলে নাজিম তাকে গুলি করে হত্যার হুমকি দেন। সে সময় বাদশা ফকির থানায় জিডি ও টাকা ফেরত পেতে আদালতে মামলা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নাজিম উদ্দিন দলবল নিয়ে রাতে তার বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রীকে মারধর করেন। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে অবৈধ গর্ভপাতের মিথ্যা অভিযোগে তাকে এক বছরের কারাদণ্ড ও দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। বিনা অপরাধে দুই মাস তিন দিন জেল খাটেন বাদশা ফকির। এসিল্যান্ড নাজিমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নামে মানুষের দোকান ভাঙচুর, ব্যবসায়ীদের নাজেহালসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
মাগুরার জেলা প্রশাসক ড. আশরাফুল আলম বলেন, অসদাচরণ, অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগে মহম্মদপুর উপজেলার সাবেক এসিল্যান্ড নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে সে সময় বিভাগীয় মামলা হয়। সেই মামলার তদন্ত চলছে।
পাঠকের মতামত